Fri. May 3rd, 2024

প্রবন্ধ

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষক অথবা কৃষি সংক্রান্ত কাজে নির্ভরশীল।এখানকার মানুষ খুবই সহজ সরল আর সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তাদের চাহিদাও কম। পেট ভরে ভাত খেতে পারলেই তারা খুশি।কিন্তু সামান্য ভাত কাপড় যোগাতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়। তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পরে।বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ঋণদানকারীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। তারা সামান্য ঋলেরবিপরীতে উচ্চ হারে সুদ নিয়ে থাকে। সুদের কিস্তি জমা দিতে অনেককে ভিটামাটি ত্যাগ করতে হয়।মানুষ দরিদ্র থেকে হয় আরো দরিদ্র

খাজা মুঈন চিশতি

সুদ ও ক্ষুদ্র ঋণ

মুঈন চিশতি

ঋণ দেয়া ও নেয়ার রেওয়াজ আদিকাল থেকে মানবসমাজে প্রচলিত।

ঋণের বিনিময়ে সুদ গ্রহণ, প্রদান ও নানা সুবিধা ভোগ করার নিয়ম ছিল স্বীকৃত প্রথা। ভারতবর্ষ, আরব, রোমান ও পারস্য সভ্যতায় এমন প্রথার নজির দেখা যায়। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আগমনের পর ঋণের বিনিময়ে উপঢৌকন, সুদ ও অন্যান্য ‘সুবিধা’ প্রদান ও গ্রহণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল বৈশ্বিক প্রথার বিরুদ্ধে উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ।

বিনা সুদে ও বিনা লাভে ঋণ প্রদান ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ নামে পরিচিতি লাভ করে। জনকল্যাণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এর মুখ্য উদ্দেশ্য।

সুদনির্ভর ‘ক্ষুদ্রঋণ’ মূলত ব্যবসা, আর ‘কর্জে হাসানা’ মানবসেবা, ইবাদত ও পুণ্যকর্ম। ক্ষুদ্রঋণ নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ে।

 অন্য দিকে কর্জে হাসানার ক্ষেত্রে এর গ্রহীতা যৌক্তিক কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা আছে। এতে পুণ্য বৃদ্ধি পায়।

দারিদ্র্য মূলত জাতীয় অভিশাপ ও বিশ্বব্যাপী একটা চ্যালেঞ্জ। সম্পদের অসম প্রতিযোগিতায় কিছু ভাগ্যবান মানুষ কোটিপতি হয়ে যায় এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে বঞ্চিত থাকে।

দারিদ্র্য সামাজিক কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করে এবং এতে অপরাধপ্রবণতার সূচক হয় ঊর্ধ্বমুখী। ভূমিহীন ও প্রান্তিক পরিবার মানবাধিকার, পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ খাবার পানি, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও স্যানিটেশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

 এর পেছনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা, পালাক্রমে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, লুটপাট, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান।

২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ১.২৯ বিলিয়ন।

এর মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ভারতে এবং ১৭৩ মিলিয়ন চীনে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ছয় কোটি ৩০ লাখ।

এর মধ্যে পল্লী অঞ্চলে ২৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, শ্রমের বাজার সৃষ্টির নিশ্চয়তা দারিদ্র্য প্রভৃতি থাকলে সহনীয় মাত্রায় পৌঁছতে বেশি দিন লাগবে না।

আদিকাল থেকে সমাজে দারিদ্র্য ছিল এবং বর্তমানেও আছে। সমাজের প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের আত্মনির্ভরশীল করা মানবসেবা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

পুঁজিবাদী বিশ্বে দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ব্যবসা করার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়; যার আধুনিক নাম ‘সামাজিক ব্যবসা’ (Social Business) ও ‘ক্ষুদ্রঋণ’। পুঁজিপতিরা এনজিওর মাধ্যমে এসব অর্থলগ্নি করে থাকে। এর নেপথ্যে অবশ্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত।

পুঁজির যারা মালিক, তারা বিনা উদ্দেশ্যে এক পয়সাও বিনিয়োগ করে না। বিত্তশালীরা ইসলামী বিধিবিধান মেনে জাকাত, সাদাকাহ ও কর্জে হাসানা প্রদান করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষ নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জাতীয় উৎপাদনে তারা নিজেদের কর্মশক্তি নিয়োজিত করতে পারবে। সামাজিক নির্দেশনা, ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোকে শত্তিশালী করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি প্রদানের পথ- কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ।

কর্জে হাসানা ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। মহানবীর সা: ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব ১০ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার ১৮ গুণ।

 বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনা সুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ দিয়ে অসহায় পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে।

কর্জে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিপর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও তা আজো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। এ ক্ষেত্রে কিছু অপরিহার্য নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।

 যেমন- কর্জে হাসানা হতে হবে সম্পূর্ণরূপে বন্ধকহীন (Mortgage Free), দু’জন গ্যারেন্টর থাকবেন, যারা ঋণগ্রহীতাকে সত্যায়ন এবং তার ব্যবসায় মনিটর করবেন।

ব্যবসায়ের পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যাংক বা ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ সহায়তা দেবেন এবং ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা হবে।

ঋণের পরিমাণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন, তবে সাধারণত তা ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা হতে পারে। ঋণের মেয়াদ ২৪ মাস থেকে পাঁচ বছর হতে পারে। কিছু খাতে কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ সুফল বয়ে আনতে পারে।

যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্যচাষ, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন প্রভৃতি।

অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিলে নিরক্ষরতা দূরীভূত হবে। কর্জে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা, জরিমানা প্রভৃতি থাকবে না।

নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরতযোগ্য।

ঋণগ্রহীতা ইচ্ছা করলে ঋণের পুরো অর্থের ১ শতাংশ ইন্স্যুরেন্স করতে পারবেন শরিয়াহ পরিচালিত যেকোনো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে।

তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছাধীন। ইন্স্যুরেন্স করা হলে ব্যবসার ক্ষতি, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে।

‘ক্ষুদ্রঋণ’ ও ‘দারিদ্র্যবিমোচন’ সাম্প্রতিক সময়ের খুব আলোচিত পরিভাষা।

অভাবগ্রস্ত মানুষের দারিদ্র্যকে কাজে লাগিয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ‘ক্ষুদ্রঋণ’ (Micro Credit)।

কিন্তু এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন তো হয়ই না, বরং তৃণমূল পর্যায়ে সুদের বিস্তার ঘটে, তৈরি হয় ‘নতুন কাবুলিওয়ালা’।

কয়েক বছর আগে ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনমান কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ (Caught in Micro Debt) নামক প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘ক্ষুদ্রঋণ’ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যর্থ এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে।

প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ুক ” করজে হাসানা ” উদ্যোগ।গড়ে উঠুক একটি সুদ মুক্ত সমাজ।_______________________________

ফাহিম সিদ্দিকী

সত্যি বলতে কী, জীবনে খুব বড় ধরণের আর্থিক সংকটে পড়িনি। বড়ো ছেলে বলে পারিবারিক সাপোর্ট পেয়েছি বেশ, ছোটোখাটো সংকটে বন্ধুরা ছুটে এসেছে, দ্বীনি ভাইয়েরা সার্বক্ষণিক দু’হাত বাড়িয়ে সহযোগিতা করেছে।

কখনোই টাকার পাহাড় গড়তে চাইনি। তবুও টাকা লাগত; বিশেষ করে ছাত্রজীবনে। এমন কিছু মুহূর্ত আসত যখন পরিবার, বন্ধু, দ্বীনি ভাই কারও কাছে টাকা চাওয়ার অবস্থা থাকত না। সাময়িক সময়ের জন্য ২/৩ হাজার টাকা করজে হাসানা পেতে ২/৩ ঘন্টা ধরে ভাবতাম। দুচোখ ফোনবুকে একজন টাকাওয়ালা মানুষকে খুঁজত। যে মানুষটিকে ফোন দিলে বলবেন- ‘ঠিক আছে, নিয়ে যাও।’ কোনো কোনো নাম দেখে ভাবতাম, এই মানুষটি হয়তো করজ দিবেন। ডায়াল করতাম। আবার সাথে সাথেই কেটে দিতাম। যদি না বলে ! হয়তো ওপাড়ে মিসকল চলে যেত।

ফোন ব্যাক করলে রিসিভ করে বলতাম, আপনাকে/তোমাকে/তোকে মনে পড়ছিল খুব; তাই মিসকল দিয়ে স্বরণ করছিলাম। সেই সময়টাতেই ভাবতাম, আমার কিছু টাকা থাকলে একটা করজে হাসানা ফান্ড গঠন করতাম। পরিচিত ও কাছের মানুষদের চরম মুহূর্তে একটু হাত বাড়িয়ে দিতে পারতাম। একদিন পরিচিত বড়ো ভাইয়ের ব্যবসায়িক অফিসে গিয়েছিলাম।

দেখলাম, তারা তিনজন বন্ধু মিলে করজে হাসানা ফান্ড গঠন করেছেন। তার হিসাব চলছে। ১ লাখ টাকার ফান্ড। তাদের পরিচিত মানুষদের করজে হাসানা দেন। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমিও আমার পরিচিত সার্কেল নিয়ে করজে হাসানা ফান্ড গঠন করব। আলহামদুলিল্লাহ্‌, কিছু প্রিয় মানুষদের নিয়ে আমরা ১ লাখ টাকার একটা ফান্ড ওপেন করেছি।

পরিচিত ও কাছের মানুষদের আমরা করজে হাসানা দিই। ইতোমধ্যে আমাদের ফান্ড থেকে অনেক প্রিয়জন অনেকবার করজে হাসানা গ্রহণ করেছে। যথাসময়ে তারা টাকা ফেরতও দিয়েছেন। এ বড়ো তৃপ্তির ব্যাপার। আমাদের পরিচিত সার্কেলে ঘোষণা দেওয়া আছে, ছোটোখাটো কোনো ঋণ প্রয়োজন হলে হেজিটেশন ছাড়াই করজে হাসানা ফান্ড থেকে নিতে পারবেন। ফ্রেন্ডলিষ্টের অনেকেই হয়তো ‘করজে হাসানা’ টার্ম বুঝতে পারছেন না। এ ব্যাপারে একটু ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি। ‘করজ’ অর্থ ঋণ, ধার বা করজ; আর হাসানা অর্থ উত্তম। উভয়ে মিলে ‘উত্তম ঋণ’।

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কাউকে ধার, ঋণ, করজ বা লোন দেওয়ার পর তার উপর অতিরিক্ত কিছু না নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরে ঠিক সেই পরিমাণ ফেরত নেওয়াকে করজে হাসানা বলা হয়।

এই করজে হাসানা টাকা, কোনো সম্পদ, পণ্য- সবকিছু হতে পারে। করজে হাসানার মূল শর্ত অতিরিক্ত কিছু নেওয়া যাবে না ( নিলেই সুদ)। অতিরিক্ত তো দূরের কথা, এতে বাহবা, কৃতিত্ব বা সুনাম অর্জন করার নিয়তও করা যাবে না। সমপরিমাণ ফেরত দেওয়ার শর্তে কাউকে নির্ধারিত সময়ের জন্য কোনো কিছু ব্যবহার করতে দেওয়ার নামই ঋণ বা কর্জ।দেখুন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মানুষ প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই করছে। এখানে বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক দৈন্যতায় ঈমান নিয়ে টিকে থাকা সত্যিই অনেক কঠিন। আমি খুব কাছে থেকে অনেক পরহেজগার মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য গুনাহের পথে পা বাড়াতে দেখেছি।

জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনেক বিশ্বাসী মানুষকে বাধ্য হয়ে সুদের পথে যেতে হয়েছে। আমাদের দেশের এনজিওগুলো সুদযুক্ত লোন দিতে পা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। করজে হাসানার দরজা বন্ধ বলেই সুদের রাস্তা প্রসারিত হচ্ছে। সত্যি তো এটাই, কিছু কিছু সময়ে আমাদের সামান্য কিছু টাকার খুব বেশি প্রয়োজন হয়। এই মুহূর্তে ‘করজে হাসানা’র পথ খোলা থাকলে, তাকে সুদের লোন নিতে হয় না। সুদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে করজে হাসানার পথ সম্প্রসারণ করাটা শরিয়তের অন্যতম দাবি।

ক্যাপিটালিজম মুসলিম মানস থেকে সচেতনভাবে করজে হাসানা টার্ম উচ্ছেদ করেছে। করজের বদলে ‘সঞ্চয় আর বিনিয়োগ’ মগজে প্রোথিত করে দিয়েছে। ইসলামি অর্থনীতির এক অসাধারণ মানবিক সমাধান করজে হাসানা নিয়ে কোনো আলাপ নাই। সুদমুক্তির লড়াই করতে রাজি আমরা, কিন্তু করজে হাসানা নিয়ে কাজ করতে নারাজ। আসমান থেকে ঐশি মদদ এসে যেন সুদমুক্ত সমাজ উপহার দিবে। খুব ভালো হতো যদি রাষ্ট্র সরকারি উদ্যোগে করজে হাসানা ফান্ড চালু করত। এতে অনেক দানবীর নিশ্চয় দান করতেন। অনেকে ওয়াকফ করতেন। রাষ্ট্রও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সেই ফান্ডে ওয়াকফ করে দিত।

যেহেতু এই মুহূর্তে এমন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সম্ভব নয়; তাই স্বচ্ছল মুসলিম ভাইদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা কিনা সুদমুক্ত ইসলামি সমাজের স্বপ্ন দেখেন, তাদের আর অপেক্ষা করলে চলবে না।পরিচিত সার্কেলে কয়েকজন মিলে একত্রে কিছু টাকা নিয়ে একটা ফান্ড করুন। সেই ফান্ড থেকে পরিচিত মানুষদের করজে হাসানা দিন। ছোটো ছোটো পরিমাণে দিন। আপনি নিজেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সাপোর্ট পাবেন ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে/মহল্লায়/ক্যাম্পাসে এমন একটি ফান্ড থাকলে, সুদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, চিন্তা করেছেন?

আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমাদের করজে হাসানা ফান্ড এগিয়ে চলছে। আমরা যা করি– পরিচিত সার্কেলে করজে হাসানা দিই।- নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত নিই। – দু’জন সাক্ষী রাখার চেষ্টা করি। – ৫ হাজার টাকার বেশি কাউকে করজে হাসানা দেই না। আশা করছি, এই স্ট্যাটাস পড়ে অনেকেই নিজ নিজ সার্কেলে করজে হাসানা ফান্ড গঠন করে সুদমুক্ত সমাজ গড়ার লড়াই শুরু করবেন ইনশাআল্লাহ্‌।

ছাত্র হলে ১০ জন ছাত্র মিলে ১০ হাজার টাকায় শুরু করুন। কর্মজীবী হলে ১০ জন সহকর্মী ও বন্ধু নিয়ে ৫*১০= ৫০,০০০/= টাকায় শুরু করুন। ব্যবসায়ী হলে সামর্থ অনুযায়ী সর্বোচ্চ নিয়ে শুরু করুন। দেখবেন, এই ক্ষুদ্র লড়াইটা ধীরে ধীরে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।

সুদমুক্ত সমাজ গঠনে শুধু একাডেমিক বয়ান না দিয়ে আসুন নিজ নিজ জায়গা থেকে ইনিশিয়েটিভ নিই। কেবল একটা বক্তৃতা দিলেই সুদ উড়ে যাবে না; দরকার বাস্তব সমাধানের উদ্যোগ। ‘কে সে, যে আল্লাহকে করজে হাসানা (যে বিনিয়োগ নিঃস্বার্থভাবে দেয়া হয়) প্রদান করবে? তিনি তার জন্য এটা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন।’ (সূরা বাকারা:২৪৫) বাংলাদেশের তরুণদের বিনীত অনুরোধ করি, কমিউনিটি বেইজড ‘করজে হাসানা’ ফান্ড গঠন করুন। নিজ গ্রামে-মহল্লায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, শহরে নিজেদের সার্কেলে এই উদ্যোগ নিন। দেখবেন, চরম কঠিন মূহুর্তে আপনি নিজেও অনেকটা বেনিফিটেড হচ্ছেন। সুদমুক্ত অর্থনৈতিক জীবনে করজে হাসানা দারুণ ফলপ্রসূ একটা উপাদান। ক

্যাপিটালিস্টিক পেট পূজোকদের কথা আলাদা। এই জমিনের সহজ-সরল সাধারণ মানুষদের কাছে বিকল্প অর্থনৈতিক সমাধান না-দিয়ে কেবল সুদমুক্ত জীবনের নসিহা করাই যথেষ্ঠ না। পেটের প্রশ্নে আপনাকে বাস্তবিক সমাধান দিতে হবে।ছোটো ছোটো কিছু উদ্যোগ আমাদের জীবনব্যবস্থাকে মানবিক সমাধান হিসেবে প্রমাণ করবে। আসুন, সকলে এই ছোট্ট বিষয়ে নজর দিই।স্বপ্ন দেখি, একটি সুদমুক্ত কল্যাণমুখী প্রিয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।Copy_পেস্ট

কর্যে হাসানায় রোজ গার্ডেন

মুঈন চিশতি

রোজগার্ডেন বা ঢাকার হুমায়ুন সাহেবের বাড়ী প্রতিষ্ঠার অর্থ যোগান দিয়েছে বিনাসুদে ধার বা “কর্জে হাসানা”। তাই- “কর্জ নিয়ে গর্জ নয়সবাই সবার বন্ধু হয়করজ দেবো গরজেলাভ হবে সমাজেবিনা সুদে ধার ফিরে আসুক আবার”ঢাকার রোজগার্ডেন বা গোলাপবাগ বর্তমানে যা হুমায়ুন সাহেবের বাড়ী বলে খ্যাত, যেখানে ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন আওয়ামীলীগের গোড়াপত্তন হয়।

সেই রোজগার্ডেন কিন্তু প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো কর্জে হাসানা বা বিনাসুদে ধারের মাধ্যমে। বাবু নলিনী কান্ত দাস প্যারিদাস রোডের নাম করা পুস্তক ব্যবসায়ী। চলনে বলনে জমিদারী জৌলুশ। প্রতি বৈকালিক আড্ডায় যোগ দেয় বলধা গার্ডেনে।

একদিন জুড়িগাড়ি করে বলধা গার্ডেনে প্রবেশ করায় বলধার জমিদারের আঁতে ঘা লাগে জাত প্রথার ধুঁয়া তুলে তাকে সেখানে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন।নলিনী বাবু তখন কিরা কাটেন তিনি ঢাকায় এমন এক বাগানবাড়ী করবেন যা দেখে নগরবাসীর চোখ ধাঁধায়। তিনি তার বন্ধু সোনারগাঁয়ের জমিদার এবং ঐসময়ের ঢাকা মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান কাজী বশীরের পরামর্শে তৎকালীন ঢাকার উত্তর পূর্ব প্রান্তের নিবিড় এলাকায় গড়ে তোলেন ফরাসী ও মোঘল স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী রোজগার্ডেন।

ইট-সুরকির কারুকাজ মন্ডিত এই বাগান বাড়ীতে ছিলো হাজার রকমের ফুল যার মধ্য বেশিরভাগই গোলাপ ফুল। এখানে ছিল দুর্লভ প্রজাতির গোলাপ লাল কালো সাদা গোলাপ ছিল এখানে। এই বাগানে মাঝে ফটক বরাবর ছিল ফ্রান্স থেকে আনা মার্বেল নারী ভাস্কর্য যা অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে মনে হয়। এই বাগানবাড়ী করতে যেয়ে নলিনী বাবুর অর্থের টান পড়ে ফলে বিনাসুদে কর্জের হাত বাড়িয়ে দেন তার বন্ধু কাজী বশীর। ঢাকাবাসী ঘূনাক্ষরেও জানতে পারেনি কাজী বশীরের এই সহযোগিতার কথা।

এই নিরব সহযোগিতা আজ সরব হয়ে আছে গুলিস্তানের কাজী বশীর মিলনায়তনে। নলিনী বাবু মৃত্যুর আগে তার ধার দেনা শোধ কল্পে রোজগার্ডেন কাজী বশীরের নামে লিখে দেন।কাজী বশীর এই বাড়ীর নাম ফলক লাগান “হুমায়ুন গার্ডেন” তার বড় ছেলের নামে আর এলাকার নামকরণ করেন গোলাপবাগ।

যা বর্তমানে ঢাকার অন্যতম আবাসিক এলাকা।বাড়ীটি বর্তমানে হুমায়ুন সাহেবের বাড়ী বলে পরিচিত। ৭০/৮০ দশকের বাংলা সামাজিক মুভিগুলোর বেশীরভাগ এই বাড়ীতেই চিত্রায়িত হয়েছে।যুগে যুগে এই ভাবে “কর্জেহাসানা” বা বিনা সুদে ঋন এমন ঐতিহাসিক এবং মহৎ কাজের নেপথ্য সহযোগিতায় কাজ করেছে।